মানুষের নিরংকুশ
স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইসলামের অবস্থান কী, তা জানতে চেয়ে হিদায়াহ নামের এক
নারী প্রশ্ন করেছিলেন। বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ইসলামী স্কলার শায়খ ইউসুফ আল
কারযাভী এই প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দিয়েছেন। ২০০৫ সালের ৩ আগস্ট অনইসলাম
ডট নেটে শায়খ কারযাভীর এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়। সিএসসিএস-এর পাঠকদের জন্যে
এটি আরবী থেকে অনুবাদ করেছেন কাজী শিহান মির্জা।
ইসলাম
স্বাধীনতার মূলনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে
খাত্তাব (রা) এ ব্যাপারে তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“তোমরা কবে থেকে তাদের ক্রীতদাস বানিয়েছ, অথচ তাদের মায়েরা তো তাদেরকে
স্বাধীন হিসেবেই জন্ম দিয়েছে!” আলী ইবনে তালিব (রা) তাঁর অসীয়তে বলেছেন,
“অন্যের জীবনকে যাপন করো না, আল্লাহ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।”
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সৃষ্টির নিয়ম ও জন্মের প্রকৃতি অনুযায়ী মানুষ
স্বাধীন। তাই স্বাধীনতা মানুষের অধিকার, মানুষ কারো দাস নয়।
ইসলাম
এসেই স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছে। অথচ সে যুগে চিন্তা, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম
এবং অর্থনীতির দিক থেকে মানুষ পরাধীন ছিল। ইসলাম মানুষকে বিশ্বাস, চিন্তা,
মত প্রকাশ ও সমালোচনা করার অধিকার দিয়েছে। মোটকথা, মানুষ যেসব গুরুত্বপূর্ণ
স্বাধীনতা বা অধিকার চায়, তার সবগুলোই ইসলাম দিয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা:
ইসলাম
এমন একটি দ্বীন যা ধর্মীয় তথা বিশ্বাসের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম কখনোই
মানুষকে জোর করে ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দেয় না।
আল্লাহর কালাম এ সম্পর্কে ঘোষণা করেছে,
“(হে নবী,) তোমার মালিক
চাইলে এ জমিনে যত মানুষ আছে তারা সবাই ঈমান আনতো; (কিন্তু তিনি তা চাননি,
তাছাড়া) তুমি কি মানুষদের জোরজবরদস্তি করবে যেন তারা সবাই মুমিন হয়ে যায়!”
(সূরা ইউনুস: ৯৯)
এটা তো মক্কী যুগের কথা। মাদানী যুগে নাজিল হওয়া সূরা বাক্বারায় বলা হয়েছে,
“(আল্লাহর) দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নেই, (কারণ) সত্য (এখানে) মিথ্যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে।” (সূরা বাক্বারা: ২৫৬)
এই
আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট আমাদেরকে পরিষ্কার দেখিয়ে দেয়, এই স্বাধীনতাকে
শ্রদ্ধা করতে, এর তাৎপর্যকে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে এবং এর মূলনীতিকে
নিশ্চিত করতে ইসলাম কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে। জাহেলি যুগে আওস ও খাজরাজ
গোত্রের নারীরা গর্ভধারণে অপারগ হলে মানত করত যে, ছেলে সন্তান জন্ম হলে
তাকে ইহুদী হিসেবে বড় করে তুলবে। এভাবে এই আরব গোত্র দুটির কিছু সন্তান
ইহুদী হিসেবে বেড়ে উঠে। তারপর ইসলামের আগমন ঘটলে আল্লাহ এসব পিতামাতাকে এ
দ্বীনের মাধ্যমে সম্মানিত করে তাদের উপর নিজের নিয়ামত পূর্ণ করলেন। তখন
কোনো কোনো পিতামাতা তাদের ইহুদী সন্তানদেরকে নিজেদের তথা পুরো উম্মাহর ধর্ম
ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। ওই সময়ে ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের
পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধ চলমান থাকা
সত্ত্বেও ইসলাম জোর করে কাউকে এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে, এমনকি তা ইসলামে
হলেও, ধর্মান্তরিত করার অনুমতি দেয়নি। “ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি
নেই” এই ঘোষণা ইসলাম এমন এক সময়ে দিয়েছে যখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বলত,
‘হয় খ্রিস্টান হও, নয়তো খুন হও’। তৎকালীন অপর পরাশক্তি পারস্যের ধর্মীয়
সংস্কারকদের ব্যাপারেও জঘন্য রকমের অভিযোগ রয়েছে।
সমাজের বিকাশের
ধারায় বা কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতার মূলনীতি আসে নি। মানবজাতির
পরিপক্বতার ফলেও তা আসে নি। আসলে এটা তো সমাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তাই
স্বাধীনতার এই মূলনীতি এসেছে আসমান থেকে, যার মধ্য দিয়ে মানবজাতি উন্নত হয়ে
উঠতে পারে। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতার মূলনীতিকে
প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে মানবতাকে সমুন্নত করতে ইসলামের আগমন ঘটেছে।
তবে
ইসলাম স্বাধীনতার এই মূলনীতিকে শর্তযুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যাতে এই
দ্বীন মানুষের হাতের খেলনায় পরিণত না হয়। ইহুদীরা সকালে ইসলামের প্রতি ঈমান
এনে বিকেলে তা প্রত্যাখ্যান করে বলতো, আমরা মুহাম্মদের দ্বীনে এমন এমন
বিষয় পেয়েছি, তাই ঈমান ত্যাগ করলাম। এমনকি তারা আজ ঈমান এনে পরদিন বা
সপ্তাহখানেক পরেই তা বর্জন করতো। এভাবে তারা এই দ্বীনের সাথে নোংরামি করতো।
এদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন,
“আহলে কিতাবদের (মধ্য থেকে) একদল
(নির্বোধ) তাদের নিজেদের লোকদের বলে, মুসলমানদের ওপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে
তোমরা সকাল বেলায় তার ওপর ঈমান আনো এবং বিকেল বেলায় (গিয়ে) তা অস্বীকার
করো, (এর ফলে) তারা সম্ভবত (ঈমান থেকে) ফিরে আসবে।” (সূরা আলে ইমরান: ৭২)
এসব
কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা চেয়েছেন এই দ্বীন যেন খেলার পাত্র না
হয়ে যায়। তাই কেউ ইসলামে প্রবেশ করার সময় যেন নিশ্চিত হয়ে অন্তর্দৃষ্টির
সাথে সচেতনভাবে ইসলামকে পুরোপুরি ধারণ করে। নয়তো পরবর্তীতে কেউ ইসলাম থেকে
বেরিয়ে গেলে স্বধর্মত্যাগের শাস্তির জন্যে তার প্রস্তুত থাকা উচিত।
অতএব, স্বাধীনতার অগ্রাধিকার বিবেচনা করলে প্রথমেই ধর্মপালন ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ আসে।
চিন্তার স্বাধীনতা:
দ্বিতীয়
প্রকার স্বাধীনতা হচ্ছে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা। ইসলাম মানুষকে
বিশ্বজগত নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করার আহবান জানিয়েছে।
“(হে
নবী,) তুমি (এদের) বলো, আমি তোমাদের শুধু একটি কথাই উপদেশ দিচ্ছি, তা
হচ্ছে, তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্যেই (সত্যের ওপর) দাঁড়িয়ে যাও, দু’দুজন
করে, (দুজন না হলে) একা একা; অতঃপর ভালো করে চিন্তাভাবনা করো।” (সূরা সাবা:
৪৬)
“(হে নবী,) তুমি বলো, তোমরা দেখো, আসমানসমূহ ও জমিনে কি কি জিনিস রয়েছে।” (সূরা ইউনুস: ১০১)
“এরা
কি জমিনে ঘুরে ফিরে (এগুলো পর্যবেক্ষণ) করেনি? (পর্যবেক্ষণ করলে) এদের
অন্তর এমন হবে যা দ্বারা এরা তা বুঝতে পারবে, এদের কান এমন হবে যা দ্বারা
তারা শুনতে পারবে, আসলে (অবোধ নির্বোধের) চোখ তো কখনো অন্ধ হয়ে যায় না,
অন্ধ হয়ে যায় সে অন্তর, যা মনের ভেতর (লুকিয়ে) থাকে।” (সূরা হাজ্জ: ৪৬)
তবে যারা নিজের আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার অনুসরণ করে, ইসলাম তাদের তীব্র সমালোচনা করেছে। এ ব্যাপারে ইসলাম বলেছে,
“আর সত্যের মোকাবেলায় (আন্দাজ) অনুমান তো কোনো কাজেই আসে না।” (সূরা নাজম: ২৮)
আবার
যারা নিজের প্রবৃত্তি, পূর্বপুরুষ, সমাজের প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয়দের
অনুসরণ করে তাদের বিরুদ্ধেও ইসলাম কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারাই কেয়ামতের দিন
বলবে,
“হে আমাদের মালিক, (দুনিয়ার জীবনে) আমরা আমাদের নেতা ও
বড়দের কথাই মেনে চলেছি, তারাই আমাদের তোমার পথ থেকে গোমরাহ করেছে।” (সূরা
আহযাব: ৬৭)
“আমরা আমাদের বাপ দাদাদের এ মতাদর্শের অনুসারী (হিসেবে) পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণকারী মাত্র।” (সূরা যুখরুফ: ২২)
ইসলাম
এ ধরনের লোকদেরকে পশু কিংবা এরচেয়েও নিকৃষ্ট হিসেবে তুলনা করেছে। অন্ধ
অনুসারী ও নিষ্ক্রিয় মনমানসিকতার লোকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে ইসলাম
চিন্তার স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। বিবেক-বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কাজ
করতে আহ্বান করেছে। মানুষের প্রতি জোর আহবান দিয়ে ইসলাম বলেছে,
“যদি তোমরা সত্যবাদী হও (তাহলে) তোমাদের দলিল প্রমাণ নিয়ে এসো!” (সূরা বাক্বারা: ১১১)
আক্বীদা
প্রমাণের জন্য ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের উপর নির্ভর করেছে। এজন্যই
ইসলামের স্কলারগণ বলেছেন, “নিশ্চয়ই উদার বুদ্ধিবৃত্তি সঠিক আসমানী
প্রত্যাদেশের ভিত্তি।” অর্থাৎ যুক্তিই প্রত্যাদেশ তথা ওহীর ভিত্তি। আল্লাহর
অস্তিত্ব ও মুহাম্মদ (সা)-এর নবুওয়তের বিষয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে বুদ্ধিবৃত্তিক
যুক্তির উপর। বিবেক বুদ্ধিই বলে উঠে, ইনি আল্লাহর রাসূল, সত্যতা এবং
মুজিজা হচ্ছে তাঁর নবুওয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণ। অন্যদিকে বিবেকের যুক্তি বলে,
অমুক তো মিথ্যাবাদী, দাজ্জাল। তার কাছে সত্যও নেই, মুজিজাও নেই। এভাবেই
ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তিকে মর্যাদা দান করে।
জ্ঞানের জগতে স্বাধীনতা:
চিন্তার
স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি উপরের আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে তুলে
ধরা হয়েছে। এরপর আসে জ্ঞানের জগতে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। আমরা দেখতে পাই,
আমাদের আলেমগণ পরস্পরের সাথে মতপার্থক্য করেছেন। তাঁরা একে অপরের ভুল
ধরেছেন এবং জবাব দিয়েছেন। এসবকে কেউই সমস্যাজনক মনে করেন নি। আমরা দেখতে
পাই, ইমাম জামাখশারী রচিত ‘তাফসীরে কাশশাফ’ গ্রন্থটিকে সুন্নী ও মুতাজিলা
উভয় দলের তাফসীর হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ইমাম জামাখশারী ছিলেন
মুতাজিলাপন্থী, কিন্তু তাঁর এই তাফসীর থেকে সুন্নীরাও উপকৃত হয়েছেন। এতে
কেউ কোনো সমস্যা মনে করছে না।
আলেমরা এগিয়ে আসায় এমনটা সম্ভব
হয়েছে। ইবনে মুনীরের মতো প্রখ্যাত সুন্নী আলেম তাফসীরে কাশশাফের উপর ‘আল
ইনতিসাফ মিনাল কাশশাফ’ নামে হাশিয়া তথা টীকা গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারপর
হাফিয ইবনে হাযরের মতো ইমাম এগিয়ে এসেছেন। তিনি এই তাফসীরে ব্যবহৃত হাদীসের
উপর আলোচনা করতে গিয়ে ‘আল কাফি আল শাফি ফি তাখরিজি আহাদীসিল কাশশাফ’ নামে
একটি পর্যালোচনামূলক বই লিখেছেন। এভাবেই আলেমগণ একজন আরেকজনের বই ও মতামত
থেকে উপকৃত হয়েছেন। আমরা দেখেছি, পারস্পরিক মতপার্থক্য করার ক্ষেত্রেও
ফকীহগণের অন্তরের প্রশস্ততা ছিল। এসব উদাহরণ থেকে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে
চিন্তার স্বাধীনতা ও জ্ঞানের জগতে স্বাধীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সমালোচনা ও বাকস্বাধীনতা:
ইসলাম
বাকস্বাধীনতা এবং সমালোচনার স্বাধীনতাও দিয়েছে। এক্ষেত্রে বরং সবচেয়ে বেশি
স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কারণ, উম্মাহর কল্যাণ, চরিত্র ও নৈতিকতা সংশোধনের
স্বার্থে মত প্রকাশ ও সমালোচনা করা কখনো কখনো ওয়াজিব হয়ে যায়। সবসময় হক কথা
বলতে হবে, আল্লাহর পথে কাজ করতে গিয়ে কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করা
চলবে না। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে হবে। কল্যাণের দিকে মানুষকে
ডাকতে হবে। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়ে মানুষকে বলতে হবে, আপনি উত্তম কাজ
করেছেন। আর কেউ মন্দ কাজ করলে বলতে হবে, আপনি খারাপ কাজ করেছেন।
এসব
হক কথা বলার জন্যে যখন নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না কিংবা
আপনার নিরবতাই যখন উম্মাহর ক্ষতি ও মানুষের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে,
তখন এসব কাজ অপরিহার্য কর্তব্যে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় সত্য বলা অবশ্য
কর্তব্য হয়ে পড়ে। এ কাজ করতে গিয়ে কোনো বিপদের পরোয়া করা যাবে না।
“সৎ
কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ কর। এতে বিপদ আসলে সবর কর। নিশ্চয়ই তা এক
মহান ব্যাপার”- এই হলো ইসলামের সিদ্ধান্ত। ইসলামে এমন কোনো সুযোগ নেই যাতে
করে মানুষের টুটি চেপে ধরে লাগাম পরিয়ে রাখা হবে যেন অনুমতি ছাড়া মানুষ কথা
বলতে না পারে বা ঈমান আনতে না পারে। এমনটা ফেরাউনের বৈশিষ্ট্য। ফেরাউন তার
যাদুকরদের বলেছিল, “তোমরা কি আমার অনুমতি ছাড়াই তাঁর উপর ঈমান এনে ফেললে?”
সে চেয়েছিল মানুষ যেন অনুমতি ছাড়া ঈমান না আনে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের
অনুমোদন ছাড়া কথা না বলে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা:
ইসলাম
মানুষকে শুধু চিন্তার স্বাধীনতাই দেয় নি বরং চিন্তা করতে আদেশ দিয়েছে।
মানুষ যা সত্য মনে করবে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে। শুধু তাই নয়, এর অনুসরণ
করাকে ইসলাম কর্তব্য হিসেবে ধার্য করে দিয়েছে। প্রয়োজনে অস্ত্রবলে নিজের এই
আক্বীদাকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মুসলিমদের আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা
যেন প্রয়োজনে স্বশস্ত্র পন্থায় নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে রক্ষা করে
যতক্ষণ পর্যন্ত ফিতনা দূর না হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে দ্বীন
পুরোপুরি কায়েম না হয়। কেউ নিজ ধর্ম পালনে জুলুম থেকে মুক্তি না পাওয়া
পর্যন্ত জালিমকে প্রতিহত করতে হবে।
ক্বিতাল ও জিহাদের বিধান সংক্রান্ত প্রথম যে আয়াতটি নাযিল হয়, তাতে আল্লাহ বলেন,
“তাদেরও (এখন যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া গেলো, কেননা তাদের ওপর সত্যিই জুলুম করা হচ্ছিলো।” (সূরা হাজ্জ: ৩৯)
এর পরের আয়াতেই আল্লাহ আবার বলছেন,
“যদি
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির একদলকে আরেক দল দিয়ে শায়েস্তা না করতেন তাহলে
দুনিয়ার বুক থেকে (খ্রিস্টান সন্যাসীদের) উপসনালয় ও গির্জাসমূহ বিধ্বস্ত
হয়ে যেতো, (ধ্বংস হয়ে যেতো ইহুদীদের) ইবাদতের স্থান ও (মুসলমানদের)
মসজিদসমূহও, যেখানে বেশি বেশি পরিমাণে আল্লাহ তায়ালার নাম নেয়া হয়।” (সূরা
হাজ্জ: ৪০)
অর্থাৎ যদি আল্লাহ মুসলিম ও মুমিনদেরকে স্বশস্ত্র
পন্থায় হলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার না দিতেন, তাহলে কারো পক্ষেই
আল্লাহর ইবাদত করা সম্ভব হতো না।
স্বাধীনতার সীমারেখা:
ইসলাম
অধিকারের স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু ধর্মহীনতা ও পাপাচারের স্বাধীনতা দেয়
নি। আজকাল যাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা হিসেবে দাবি করা হয়, ইসলামের স্বাধীনতার
স্বরূপ তেমনটা নয়। ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ পরিভাষা ব্যবহারের উদ্দেশ্যই হলো
যাতে ইচ্ছেমতো ব্যাভিচার, মদপান ও সব ধরনের বিভীষিকাময় কাজ করা যায়। তবে
কল্যাণ ও সংশোধনের সাথে জড়িত ব্যাপারগুলোর কোনো স্বাধীনতা সেখানে নেই।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সমালোচনা করা যাবে না, যা বিশ্বাস করা হয় তা বলা
যাবে না, উত্তম কাউকে বলা যাবে না, ‘তুমি ভালো কাজ করেছ’, খোঁড়াকে খোঁড়া
বলা যাবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে শুধু নিজেকে নষ্ট করার মধ্যে, নিজের
চরিত্র বরবাদ করার মধ্যে, নিজের চেতনাকে বিকৃত করার মধ্যে, নিজের ইবাদতকে
নষ্ট করার মধ্যে, নিজের পরিবারকে ধ্বংস করার মধ্যে।
এই যদি হয়
স্বাধীনতার অর্থ, তাহলে ইসলাম এমন স্বাধীনতাকে অনুমোদন করে না। কারণ এটা
পাপাচারের স্বাধীনতা; অধিকারের স্বাধীনতা নয়। ইসলাম চিন্তাভাবনা, জ্ঞান,
মতামত গঠন, মত প্রকাশ, সমালোচনা, বিশ্বাস ও ধর্মের স্বাধীনতাকে অনুমোদন
করে। এই স্বাধীনতাগুলোর উপরই মানবজীবন দাঁড়িয়ে আছে। যা অন্যের ক্ষতিসাধন
করে না- এই আইনী শর্ত ও নীতির চুক্তিতে ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দেয়।
ইসলামের সাধারণ মূলনীতিটি হলো, “ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করাও
নয়।” আদতে এমন কোনো স্বাধীনতা কি আছে, যা নিজের বা অন্যের ক্ষতিসাধনের
অনুমোদন দেয়? যদি থাকে তাহলে এমন স্বাধীনতাকে মোকাবেলা করা উচিত, শর্তাধীন
করা উচিত। কারণ, যেখান থেকে অন্যের স্বাধীনতার শুরু হয়, আপনার নিজের
স্বাধীনতা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তাই এমন স্বাধীনতার কথা কেউই সমর্থন করে
না, যেখানে স্বাধীনতার নামে অপরকে দমনপীড়ন বা নিষ্পেষিত করা হবে।
রাস্তায়
চলাফেরার স্বাধীনতা সবারই আছে বটে, তবে রাস্তার আদবকায়দাও তো মেনে চলতে
হবে। রাস্তায় চলতে গিয়ে আপনি অপরের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে পারেন না বা
যানবাহনের পথ রোধ করতে পারেন না। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করতে পারেন না। লাল বাতি
জ্বললে আপনাকে থেমে যেতে হবে কিংবা নির্ধারিত পথেই আপনাকে হাঁটতে হবে।
এগুলোই হচ্ছে আপনার স্বাধীনতার শর্ত বা সীমারেখা। সবার কল্যাণের স্বার্থেই
এই বিধিনিষেধ ঠিক করা হয়েছে।
প্রত্যেক ধর্ম ও ব্যবস্থার মধ্যেই স্বাধীনতার এরূপ সীমারেখা রয়েছে। ইসলামও তাই করেছে। মানবতার জন্যে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা।
মূল : শায়খ ইউসুফ আল
কারযাভী, অনুবাদ : কাজী শিহান মির্জা