ড. আব্দুল বারী
ড. আবদুল বারী এমবিই ব্রিটেনের একজন বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার। তিনি বিগত বছরগুলোতে বর্তমান বিশ্বের সেরা পাঁচশত মুসলিম ব্যক্তিত্ব তালিকায় বারবার উঠে এসেছেন। ড. বারী তার সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের জন্য ২০০৩ সালে রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে সম্মানসূচক 'মেম্বার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার' উপাদিতে ভূষিত হন। বর্তমানে ইস্ট লন্ড মসজিদের চেয়ারম্যান জনাব বারী ব্রিটেনের প্রভাবশালী বিভিন্ন ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। বহু সংস্থার প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত। বাংলাদেশী বংশোদ্ভাত এই স্কলার বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে 'ম্যারেজ এন্ড ফ্যামিলি বিল্ডিং ইন ইসলাম', 'অ্যা গাইড টু প্যারেন্টিং' এবং 'রেইস, রিলিজিও এন্ড মুসলিম আইডেন্টিটি ইন ব্রিটেন' উল্লেখযোগ্য।প্রশ্ন: ব্রিটেনের সদ্য অনিুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম ভোট তুলনামূলকভাবে কম পড়ার কারণ কী?
উত্তর: নির্বাচনে জাতীয় গড়ের চেয়ে মুসলিম ভোট কম পড়েছে। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন উদাসীনতা, ভোটের ক্ষেত্রে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার কিছু দুর্বলতাও দায়ী হতে পারে।
তবে সংখ্যায় খুবই নগন্য হলেও মুসলিম কমিউনিটির সরব একটি অংশ বলে থাকে যে ভোট দেয়া হারাম। এবং মিডিয়া তাদের কথাকে সবসময় বড় করেই দেখায়। ফলে মূলধারার মুসলিম কমিউনিটির যুবকদের একটা অংশকে ভোটমুখী করতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে সার্বিকভাবে আস্তে আস্তে কমিউনিটিতে বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। এবার ১৩ জন মুসলিম এমপি হিসেবে নির্বাচিত হলেন।
মুসলিম কমিউনিটির একটা সুবিধার দিক হচ্ছে এখানে তরুণদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত অন্য কমিউনিটির চেয়ে বেশি। এই তরুণরা শুধু মুসলিম কমিউনিটি নয়, বৃহত্তর সমাজেরও সম্পদ।
প্রশ্ন: ব্রিটেনের মুসলিমদের মতো একটা সংখ্যালঘু কমিউনিটি কি সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটের ওপর আসলেই কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?
উত্তর: ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং ভোটের ফলাফলে সংখ্যালঘুদের প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস আছে। বর্তমানে ব্রিটেনে মুসলিমদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। যদি এখানকার মুসলিমরা রাজনৈতিভাবে আরো সচেতন হন এবং নির্বাচনের সময় মেধা ও ভোটের কৌশলগত দিক বিবেচনা করে প্রার্থী বাছাই করতে পারেন তাহলে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সবসময় বলেন, কখনো এক ঝুলিতে সব ডিম রাখতে নেই।
প্রশ্ন: এর মানে কি এটা যে, মুসলিমদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে তাদের সতন্ত্র কোনো রাজনৈতিক দল না গঠন করতে পরামর্শ দিচ্ছেন?
উত্তর: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি. মুসলিমদের সতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত বিবেচনাপ্রসুত নয়। বিশেষ করে চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন মুসলিমদেরকে মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের একটা অংশ নেতিবাচকভাবে দেখে থাকে।
১৯৮৯ সালে ইসলামিক পার্টি ব্রিটেন নামে একটি দল গঠণ করা হয়েছিল। কিন্তু এটা তেমন কিছু করতে পারেনি এবং ২০০৬ সালে দলটি বন্ধ করে (নিজেদের পক্ষ থেকে) দেয়া হয়। ব্রিটিশ সমাজের অংশ হিসেবে মুসলিমদেরকে মূলধারার দলগুলোর সাথেই কাজ করা উচিত এবং নীতি ও নৈতিকতার সাথে বৃহত্তর সমাজের জন্য কাজ করা উচিত।
প্রশ্ন: সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনের ফলাফলে ইসলামভিতির কোনো প্রভাব ছিল কিনা?
উত্তর: সার্বিকভাবে বললে, ব্রিটেন একটি সহনীয় দেশ। তবে বিগত বছরগুলোতে মুসলিমদের প্রতি মনোভাব বেশ নেতিবাচক হয়েছে। এটা মূলত দেশের ভেতরের এবং আন্তর্জাতিকভাবে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার কারণে হয়েছে। সেভেন ইলভেনের (লন্ডন বোমা হামলা) পর এবং ২০১৩ সালের লি রিগবি হত্যাকাণ্ডের পরপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে অনেক নেতিবাচক কথা বলা হয়েছে।
এসব কারণে এখনো মুসলিমদেরকে প্রায়ই নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসাবে দেখা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ডেভিড ক্যামেরুন একটি মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ইসলামভীতি মোকাবেলায় এবং ইসলামের সঠিক ইমেজ তুলে ধরতে ব্রিটেনের মুসলিম নেতাদের কোনো মিডিয়া কৌশল আছে?
উত্তর: কিছু মুসলিম সংগঠনের ভাল মিডিয়া কৌশল থাকতে পারে। তবে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, এদেশের মুসলিম নেতৃত্ব এ জায়গাটিতে খুবই দুর্বল। ইসলামভীতি মোকাবেলায় বা মুসলমানদের ইতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরতে সমন্বিত কৌশলের অভাব রয়েছে। মুসলিমদের ভাল কাজগুলো কমিউনিটির ভেতরেই পড়ে থাকে। সেগুলোকে একসাথে করে তুলে ধরার প্রায়স নেই। ব্যক্তির ভুল বা অপকর্মকে প্রায়ই 'মুসলিমদের সমস্যা' বলে মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। অবশ্য এসব দুর্বলতার পেছেন ঐতিহাসিক এবং বাস্তবিক নানাবিধ কারণও রয়েছে। এখানকার মুসলিম কমিউনিটি অপেক্ষাকৃত নতুন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ এবং মননের মানুষ এখানে এসেছেন। অনেকে আবার সুবিধাবঞ্চিত। তবে যাইহোক, নিজেদের ব্যর্থতার (মিডিয়া কৌশলের ক্ষেত্রে) পেছনে এসবকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো উচিত হবে না।
প্রশ্ন: আমরা কি ব্রিটিশ মুসলিমদেরকে একটি সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ হওয়া নিয়ে কথা বলতে পারি? সংগঠন পর্যায়ের ঐক্য কি পুরো কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে?
উত্তর: মুসলিমরা হচ্ছেন অনেক অনেক কমিউনিটির সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিউনিটি। ইসলামে যেহেতু কোন ধর্মীয় পদবিন্যাস (রিলিজিয়াস হায়ারার্কি) নেই এবং কমিউনিটি ক্রমবিকাশমান, ফলে জাতিগত, ভাষাগত এবং গোষ্ঠীগত দিক থেকে মুসলিমদের স্বকীয়তা রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে অনেকবার এরকম ঐক্যপ্রচেষ্টা হয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে যুক্তরাজ্যের মুসলিম নেতাদের মধ্যে অব্যাহত আলোচনার পর ১৯৯৭ সালে দ্য মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশটির মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংগঠন হলেও পুরো কমনিউনিটির প্রতিনিধিত্ব দাবি করে এই সংগঠন। বর্তমান সময়ে মুসলিমদের মধ্যে সহযোগিতা, সমন্বয় এবং চিন্তা ও কাজের উন্নতিই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
প্রশ্ন: মুসলিম তরুণদেরকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে কমনিউনিটি কী করছে এবং কী করা উচিত?
উত্তর: মুসলিমদের সুবিধা হচ্ছে তাদের কমিউনিটিতে অন্যদের চেয়ে বেশি তরুণ রয়েছে। এরা সবার সম্পদ। আর তরুণদের দায়িত্ব হওয়া উচিত সমাজের জন্য যাবতীয় কাজে অগ্রগণ্য থাকা। মসজিদ এবং কমিউনিটির নেতৃত্ব আস্তে আস্তে তরুণদের হাতেই দিয়ে দেয়া উচিত। তরুণদের কর্মউদ্যোম এবং বড়দের অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা ইতিবাচক সমন্বয় থাকতে হবে। মুসলিম তরুণদেরকে ব্রিটিনের নাগরিক জীবন এবং সমাজের সাথে আরো গভীরভাবে মিশে যেতে উৎসাহ দিতে হবে।
প্রশ্ন: ব্রিটেন কি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র না খ্রিস্টান রাষ্ট্র? এবং এই বিতর্কে আপনি ব্রিটিশ মুসলিমদেকে কিভাবে দেখেন?
উত্তর: ব্রিটেন খ্রিস্টান না ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। যদি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মানে হয় জনপরিসর এবং শিক্ষা থেকে ধর্মকে আলাদা রাখা, তাহলে ব্রিটেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। ইল্যান্ডে রাষ্ট্রীয় চার্চ রয়েছে। হাউজ অব লর্ডসেএর বিশপরা বসেন। রানী হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রধান এবং চার্চ অব ইল্যান্ডের প্রধান গভর্নর। রানীর একটি উপাধি হচ্ছে, 'বিশ্বাসের রক্ষক'। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুন সম্প্রতি চার্চ টাইমসে লিখেছেন, 'একটি খ্রিস্টান দেশ হিসেবে আমাদের মর্যাদা সম্পর্কে জনগণকে আরো সচেতন হতে হবে।' বর্তমানে ব্রিটেন এবং ওয়েলসের ৫৯ শতাংশ মানুষ নিজেকে খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দেন। যেটা ২০০১ সালে ছিল ৭২ শতাংশ।
অবশ্য ধর্মনিরপক্ষরা গর্ভপাত, সমলিঙ্গের বিয়ে, সমকামিতার শিক্ষা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে ধর্মীয় পক্ষগুলোর বাধা সত্তেও দেশটিতে আইন পাশ হওয়ার ব্যাপারকে চার্চের গুরুত্বের ক্রম ক্ষয়িষ্ণুতা হিসেবে দেখছেন।
No comments:
Post a Comment